ধারাবাহিক উপন্যাসঃ নাইয়র (পর্ব-তের)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৬:৪৩:৪৮ সন্ধ্যা
'গোলাঘর প্রজেক্ট' নিয়ে ম্যান-টু-ম্যান কন্ট্যাক্ট সিস্টেমে ওরা তিনজন নেমে পড়েছে। প্রথমে নিজেদের অতি বিশ্বস্ত চাষীদের একটা লিস্ট করা হল। এরপর পারুল, মোতাহার এবং মুজিবর তিনজন ভাগ হয়ে কৃষকদেরকে সচেতন করায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রজেক্ট একটা দাঁড়া করালেই তো হলনা। সেজন্য ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপার স্যাপার আছে। এখানে প্রয়োজন খালি যায়গা, একটি বিশাল আড়ত টাইপের মজবুত ঘর এবং সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্যাদি। মোতাহার চাইছে প্রতিটি কৃষকই একটি নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিবে। কারণ এখানে পুরোটাই তাঁদের নিজেদের স্বার্থে। তাই প্রোজেক্টের পুরো ইনভেস্টমেন্টটাও তাদেরই নির্বাহ করা উচিত। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মোতাহার কিছু সাহায্য করতে পারবে। তবে সেটা প্রথমেই বলা যাবেনা। কারণ আমাদের চরিত্রের একটা অংশ হচ্ছে, মুফতে পেলে নিজেরটা কেউ খরচ করতে চায় না।
গোলাঘরের জন্য যায়গা মোতাহার নিজেই দিবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বংশানুক্রমে মোতাহাররা কৃষক। ওদেরও অনেক চাষযোগ্য জমি রয়েছে। নিজের বাপ-দাদার এই পেশার প্রতি একটা আলাদা টান অনুভব করে মোতাহার। যদিও লেখাপড়ার জন্য ব্যস্ত থাকাতে নিজে জমিতে কখনো সেইভাবে নামতে পারে নাই, তবে এটা গর্বের বা আত্মাভিমানের জন্য নয়। আসলে ওর বাবা কখনো এই কাজটা ছেলেদেরকে দিয়ে করান নাই। প্রয়োজনও হয় নাই। কিন্তু তাই বলে নিজের পৈতৃক এই পেশার প্রতি কখনো মন থেকে অবজ্ঞা আসেনি মোতাহারের।
মোতাহারের বাড়ির উঠোনের একটু সামনে অনেকখানি যায়গা খালি পড়ে আছে। একটা আদর্শ 'গোলাঘরের' জন্য এই যায়গাটিই উপযুক্ত। তাই, সকলে নীতিগতভাবে সম্মত হলে, এখানে বিশাল এক ঘর তুলতে যায়গাটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
মুজিবর সন্তোষ মন্ডলের সাথে কথা বলছিল। সব কিছু শুনে তিনি রাজী হলেন। তার এই গ্রামে অনেক জমি রয়েছে। একজন অবস্থাপন্ন গৃহস্থ হিসাবে তার সম্মতিতে মুজিবর যারপরনাই আনন্দিত হয়। মুজিবরের লিস্টে আরো পাঁচজন হিন্দু চাষীর নাম রয়েছে। সে এই দায়িত্বটা সন্তোষ মন্ডলকে বুঝিয়ে দিতেই তিনি সানন্দে রাজী হন।
পারুল গ্রামের দক্ষিণ কান্দায় গিয়েছিল। ওর ভাগে দশ জনের একটা লিস্ট পড়েছে। পাঁচজনের সাথে কথা বলছে। সবাই ই রাজী। আর রাজী না হয়েই বা উপায় কি? ফড়িয়াদের উৎপাতে চাষীদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। বাকি পাঁচজনকে পারুল পেলো না। তবে মুজিবরের মতো সে রাজী হওয়া পাঁচজনের উপরে দায়িত্ব দিলো না। কারণ এরা যতই বিশ্বস্ত হোক না কেন, বুঝাতে গিয়ে কোনো না কোনো ভাবে কথাটা ফাঁস হতে পারে। শুরুর আগেই ফড়িয়াদের কানে ব্যাপারটা কোনোভাবেই যাক, সেটা পারুল হতে দিতে চায়না। তাই সে অপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে করল।
গ্রামের দক্ষিণ দিকটা তুলনামূলকভাবে একটু নীচু। ভীমকাঠী খালের শাখা খাল দিয়ে জোয়ারের পানি এদিকটা ডুবিয়ে রাখে। পারুল পানি বাঁচিয়ে ওর বাড়ি আসতে একটা শর্টকাট পথ ধরে। পথে রেজাউলদের বাগান পড়ে। বেশ ঘন। গাছপালায় ঢেকে থাকে। দিনের বেলায়ও কেমন গা ছমছমে ভাব। পারুল সেটা পার হতে গিয়েই ভিতর থেকে পুরুষ মানুষের গলার আওয়াজ শোনে। কয়েকজন কথা বলছে। শব্দ না পেলে সে চলেই যেতো। কিন্তু কথাবার্তার শব্দে সে একটু দাঁড়ায়। ভালোভাবে গাছপালা ভেদ করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। কিন্তু কিছু দেখতে পায়না। তাই আরো একটু কাছে যায়। সামান্য সামনেও যেতে হয়। এখানটায় গাছপালা একটু কম রয়েছে। তাই বেশ একটা ফোকরের সৃষ্টি হওয়ায় সেখান দিয়ে তাকালে ভিতরে স্পষ্ট দেখা যায়।
পারুল সেখানে অপরিচিত কয়েকজন যুবককে দেখতে পায়। এরা অন্য গ্রামের। আগে কখনো সে দেখেনি। পাশের গ্রামেরও হবে না। কারণ জয়পুর গ্রামে পারুলের অনেক পরিচিত লোক থাকাতে সেখানে প্রায়ই যাওয়া হয়। তাই অনেককেই সে চিনে। তবে এখন এখানে এদের ভিতরে মালেক শিকদারকে এভাবে দেখতে পাবে কল্পনাও করেনি। মালেক শিকদার কি করছে এই যুবকদেরকে নিয়ে? দলীয় কোনো সভাও হতে পারেনা। সেটা হলেও এভাবে গোপনে... জঙ্গলের ভিতর? একটু ভয় পেল পারুল। দ্রুত সেখান থেকে সরে ওর নিজের পথে চলে যায়। তবে মনের ভিতরে একটু আক্ষেপ রয়েই গেলো, ওরা কি বলছে শুনতে না পারায়।
মোতাহার বাজারে বেশ একটা টান টান উত্তেজনার আভাষ পায়। মানুষজন যায়গায় যায়গায় জটলা করছে। একজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর রায় ঘোষণা করা হবে আগামীকাল। কি হতে পারে, কি হওয়া উচিত তাই নিয়ে সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলোচনা করছে। পক্ষে বিপক্ষে কত যে মন্তব্য! মোতাহার এই দলগুলিকে সযতনে পাশ কাটিয়ে যায়। সবসময়ই সে এগুলো থেকে দূরে থেকে এসেছে। পরিচ্ছন্ন রাজনীতির একজন সমর্থক সে। কিন্তু প্রয়োজনে নিজ দলের সমালোচনা করতেও তার বাঁধেনা। করেও সময়ে সময়ে। এজন্য দলের জেলার শীর্ষ পর্যায়ের কোনো কোনো নেতা ওর উপর খুশী নন। দু'একজন অবশ্য ওর পরিচ্ছন্ন ভাবমুর্তির জন্য ভালোবাসেন। কিন্তু তাঁরা সেভাবে সিদ্ধান্ত নেবার সময়ে ওর জন্য কিছু করতে পারেন না।
এই এলাকার এমপি স্বাধীনতার একচ্ছত্র দাবীদার দলের। তবে যুদ্ধাপরাধের দায় মাথায় নিয়ে যার রায় আগামীকাল হতে যাচ্ছে, তিনিও কম প্রভাবশালী নয়।একসময় তিনি এখানের এমপি ছিলেন। সাধারণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে এবং প্রতিবেশী একটি দেশের বিরোধিতাকে মূল ইস্যু করে, এই অঞ্চলটা আসলেই এই দলটির নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলটির ক্ষমতার পাল্লা ভারী হওয়াতে এরা আপাতত নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। নিষ্ক্রিয়, তবে দৃশ্যমান। হাবিব মুন্সী সরাসরি এই দলের উপজেলা পর্যায়ের একজন 'আধ্যাত্মিক নেতা'। এখানে 'আধ্যাত্মিক' দ্বারা গোপন বোঝানো হয়েছে। সবাই জানে, তারপরও সে গোপন। শুনতে একটু হাস্যকর মনে হলেও বাস্তবতা এটাই জানায়। সবাই জেনেও না জানার ভান করতে বাধ্য হলে, তখন তো এমনই মনে হয়।
মোতাহার ওর অফিসের চেয়ারে হেলান দিয়ে একটু আরাম পেতে চায়। কিছুক্ষণ এভাবে ঝিম মেরে থেকে উঠে বসে। মোবাইল হাতে নেয়। ফেসবুকে লগ অন করে। নোটিফিকেশনগুলোতে চোখ বুলিয়ে যেতে যেতে একটিতে গিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। একজন নাকি মহা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বিরুদ্ধে কিছু একটা লিখেছে। সে আবার হিন্দু ধর্মের অনুসারী। এই নিয়ে ফেসবুকে বিরাট তোলপাড়। লগ আউট করে বের হয়ে আসে মোতাহার। কিছুটা বিরক্ত। সেই বাবরি মসজিদ আমল থেকে শুরু করে ধর্মান্ধ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে কিছু মতলববাজ ধর্ম ব্যবসায়ী এবং ইতর রাজনীতিবিদ, এদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করে আসছে। ফেসবুকের এই ইস্যুটাও হয়তো তেমনই কিছু একটা। আবারও কি নতুন করে কিছু একটা ঘটতে চলেছে?
হঠাৎ বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে মোতাহার। আগামীকাল একজনের যুদ্ধাপরাধের রায় ঘোষিত হতে যাচ্ছে। এমন সময়ে একজন সনাতন ধর্মের কারো ফেসবুকে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তকের বিরুদ্ধে অবমাননকর পোষ্ট প্রদান। এসব কিছু কি সেই পুরনো দিনের মতো অঘটনের দিক নির্দেশ করছে না? কিন্তু ভাবনার বিষয় হচ্ছে, এই মুহুর্তে সম্প্রীতি নষ্ট করে কারা লাভবান হবে? কোন গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষিত হবে এই গন্ডগোলের ভিতরে?
একটা অমানিশার কালো মেঘ যেন শ্রীরামকাঠী গ্রামকে গ্রাস করতে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। আর একজন মোতাহার সেটা বুঝেও কিছুই করতে পারছেনা। এতোটাই অক্ষম এবং অসহায় সে। ভিতরে ভিতরে এক নিস্ফল ক্রোধে ছটফট করতে থাকে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়, মালেক শিকদারের মতো যদি সেও নষ্ট রাজনীতির ধারক-বাহক হতো, তবে আজকের এই মুহুর্তে অন্তত ভিতরের খবর জানতে পারত... নিজের গ্রামকে রক্ষা করার একটা চেষ্টা তবুও করতে পারতো। পরক্ষণেই ভাবে, তখন হয়তো মনটা এতোটাই কালো হয়ে যেতো, তখন এই ভালো করার ইচ্ছেটাই মরে যেতো।
নিজের ইউনিয়ন পরিষদের রুমের ভিতরে একজন চেয়ারম্যান নিজের সকল ক্ষমতার ভিতরে থেকেও একজন ফাঁদে পড়া সর্বশান্ত মানুষের উপলব্ধিতে বিদীর্ণ হয়ে পায়চারি করতে থাকে।
... ... ...
অবশেষে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সেই সাবেক এমপির মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া হল। এই রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশব্যাপী কতো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হল। প্রশাসনের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল বলতে গেলে। সাজসাজ রব পরে গেলো তাদের মাঝে। সাধারন জনগন আতংকে অস্থির হয়ে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করছিল। সবারই মনে উৎকণ্ঠা, কি জানি কি হতে যাচ্ছে। সরকার তো বিজিবিকেও মাঠে নামালো। আর রায়ের আগের রাতে লিস্ট করে করে, সাম্প্রদায়িক একটি দলের চিহ্নিত নেতা-কর্মী এবং ঐ দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতাদেরকে গ্রেফতার করা হল। বেশীরভাগ নেতারাই আগে ভাগেই 'আন্ডারগ্রাউন্ডে' চলে গেছেন।
এরপরও প্রতিক্রিয়া হল স্মরণকালের ভয়াবহতা নিয়েই। দেশের গুরুত্বপুর্ণ কয়েকটি বিভাগীয় এবং জেলা শহরে পুলিশের সাথে মৃত্যুদন্ড পাওয়া নেতার দলের কর্মীদের সাথে দফায় দফায় বলতে গেলেই যুদ্ধই চলল। পুলিশ সদস্যদের উপর এক যোগে আক্রমণ করা হল। ইট দিয়ে কয়েকজনকে গুরুতর আহত করে রাজপথে ফেলে রাখা হল। মৃত্যুও হল কয়েকজনের।আর মিডিয়ার কল্যাণে এইসব অরাজক পরিস্থিতি দেখে পাবলিকের ঘুম হারাম হয়ে গেলো। অফিস ফেরত স্বামী-সন্তানের জন্য নিদারুন উদ্বেগে সময় কাটতে থাকে পরিবারের স্বজনদের।
বাসে পেট্রোল বোমা মারা হল। ঝলসে গেলো কত নিরীহ মানবদেহ। রাস্তার পাশের গাছগুলোকে কেটে সেগুলো দিয়ে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হল। মোটকথা একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে প্রশাসন নাজেহাল হয়ে সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে চরম পথটি বেছে নিলো। সরাসরি গুলি চালালো। শ'খানেকের বেশী মানুষ মারা গেলো। তবে সরকার কোনো ছাড় না দেয়াতে পরিস্থিতি রক্তাক্ত হলেও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসার লক্ষণ দেখা দিলো।
শ্রীরামকাঠী গ্রামেও এই রায়-পরবর্তী গরম বাতাসের ছোঁয়া কিছুটা হলেও লাগল। তবে তা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত তর্ক-বিতর্কের ভিতর দিয়েই সীমাবদ্ধ রইলো। দু'একটি ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল নাজিরপুর কলেজ ক্যাম্পাসে। তবে এর জের গ্রাম পর্যন্ত আসার আগেই থিতিয়ে গেলো। কিন্তু অন্য এক অশুভ ছায়া যেন গ্রামটিকে ঢেকে দিতে আসছিল। প্রচন্ড ঝড় আসার আগমুহুর্তের অবস্থা বিরাজ করছে যেন।
পারুল সেদিন রেজাউলদের বাগানের ভিতরে অচেনা যুবকদেরকে মালেক শিকদারের সাথে দেখার কথা মোতাহারকে জানায়। এতে মোতাহার আরো উদ্বিগ্ন হয়। কিছু একটা যে ঘটতে চলেছে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেটা যে কি এবং কোন দিক দিয়ে আসবে তা জানা না থাকায়, মোতাহার ভিতরে ভিতরে কষ্ট পায়। তবে পারুলকে টেনশনে না রাখার জন্য সে ব্যাপারটি অতি স্বাভাবিক হিসেবে নিতে বলে।
মুজিবর আজ সকাল থেকেই ক্লাব ঘরের ভিতরে বসে নতুন একটি কবিতা লিখায় ব্যস্ত রয়েছে। 'বেদনার অণুকাব্য' নাম দিয়েছে। কয়েকটি লাইন এমন-
' নীল বেদনারা
সময়ের প্রক্ষেপনে,
কখনো লাল, সবুজ বা হলুদ-
কিংবা বাতাসী রঙের প্রলেপ এনে
এ হৃদয়কে রাঙাতে চায়।
আর নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতো,
মরিচীকার পিছু ধাওয়া এ হৃদয়,
ভালোবাসার মায়াজাল ছিন্ন করে
অনুক্ষণ গেঁথে চলে
বেদনার অণুকাব্য!'
আরো কিছু ভাবনা কেবলি ব্রেইনের জালিগুলোতে আসি আসি করছে, এমন সময় এক সাথে অনেক মানুষের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার শব্দ পায় সে। ভেজানো জানালাটা আরো একটু ফাঁক করে দেখতে চেষ্টা করে। তবে যা দেখে তাতে ওর লিখা আর ভাবনা-চিন্তা সব মাথায় উঠে যায়। প্রায় শ'খানেক যুবক উত্তেজিত ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। এদের সবাইকে অচেনা লাগে। তবে আশপাশের গ্রামের হবে। হাতে লম্বা দা, টেটা, সড়কি আর বাঁশের লাঠি। মারমুখি ভঙ্গীতে এরা বাজারের দিকে যাচ্ছে।
মুজিবর বের হয়ে দরোজার সামনে দাঁড়ায়। দলটির সর্বশেষ মাথার একজনকে জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটি কি। সে যা জানায় তাতে মুজিবরের পিলে চমকে যায়। এরা সবাই গ্রামের ঋষি বাড়ি আক্রমণ করতে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে তা আর জিজ্ঞেস করা হয়না মুজিবরের। মোবাইল টিপে বাজারে অবস্থানরত মোতাহারকে কল করে। ওকে জানানো দরকার সব।
শ্রীরামকাঠী গ্রামটির মাঝামাঝি হিন্দু পরিবারগুলোর বসতি। বাজার হল একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে, আর উত্তর প্রান্তের শেষ সীমায় রয়েছে কুদ ঘাটা। এখান থেকেই গ্রামের শুরু। পশ্চিম প্রান্তে তেমন বেশী কিছু নেই। খালের ওপারে শুধু কিছু খেতি জমি। সব বাড়িগুলো রয়েছে পুর্ব প্রান্তে। হিন্দু বাড়িগুলোর ভিতরে সন্তোষ মন্ডলদের বাড়ির পাশেই ঋষি বাড়ি। আর ঋষি বাড়িকে ঘিরে রয়েছে কৈলাসদের ভিটা এবং কালিপদদের সাহা বাড়ি। ঋষি বাড়ির ছেলেরা সবাই ঢাকাতে থাকে। এরা পড়ালেখার সুবাদে সেখানেই অবস্থান করছে। কেউ কেউ চাকরিও করছে।
আক্রমণকারীরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে এলো। একদল উত্তর প্রান্ত থেকে এসেছে। এদেরকেই মুজিবর দেখেছে। আর একদল ট্রলারে করে বাজারের ব্রীজের কাছে নামলো। সেখানেও প্রায় শ'খানেক মানুষ হবে। তৃতীয় দলটি একেবারে ক্ষেতের ভিতর দিয়ে চলে আসলো। সবারই লক্ষ্য ঋষি বাড়ি আক্রমণ করা। ফেসবুকে যে পোষ্ট থেকে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) বিরুদ্ধে অবমাননাকর বক্তব্য লিখা হয়েছে, সেই মানুষটি নাকি ঋষি বাড়ীর এক ছেলে। সে ঢাকায় একটি কলেজে পড়ালেখা করছে। এজন্য এই 'ইসলামের চেতনায় জাগ্রত' দলটি খোঁজ-খবর নিয়ে জেহাদি চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে এসেছে। এবার আর কাফেরদের রক্ষা নেই।
মোতাহার মুজিবরের মোবাইলে সব জানতে পারে। তখন সে লঞ্চ ঘাটের কাছে ছিল। বাজারের পরিচিত সবাইকে কিছু বলার আগেই সন্তোষ মন্ডলের মিষ্টির দোকানের কাছে শোরগোল ও হৈচৈ শুনতে পায়। দৌড়ে সেখানে পৌঁছাবার আগেই দেখে ভাংচুর শুরু হয়ে গেছে। পঞ্চাশ-ষাটজন যুবক যাদেরকে মোতাহার আগে দেখেনি, তাঁরা মিষ্টির দোকানটি তছনছ করে দিলো। কয়েকজন সন্তোষ মন্ডলকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসছে দেখতে পেলে মোতাহার তাঁকে রক্ষা করতে এগিয়ে যায়। প্রথমে মোতাহারকেও আক্রমণকারীরা আঘাত করতে চায়। একজন তো বাঁশের লাঠি দিয়ে মোতাহারের ঘাড়ে আঘাতও করে। কিন্তু কয়েকজন ওকে চিনতে পেরে তাদেরকে নিবৃত করে এবং বাজার ত্যাগ করে ঋষি বাড়ির দিকে চলে যায়। একেবারে শেষের দিকে এদের ভিতরে গ্রামের কয়েকজন মুসলমান যুবককেও মোতাহার দেখতে পেয়ে নিদারুন কষ্ট পায়। তবে ওর তখন একটাই লক্ষ্য ছিল, তা হল সন্তোষ মন্ডলকে যে কোনো উপায়ে রক্ষা করা। সে দ্রুত ওর ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে আহত সন্তোষ মণ্ডলকে নিয়ে যায়।
এদিকে ঋষি বাড়ির লোকজন যাদের ভিতর অধিকাংশই মহিলা, শিশু এবং বৃদ্ধ, এরা দূর থেকে শ'য়ে শ'য়ে মানুষদেরকে 'নারায়ে তাকবির- আল্লাহু আকবর' স্লোগান দিয়ে আসতে শুনেই এক অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকে। কারণ এর আগেও কয়েকবার তাদেরকে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার ভিতর দিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চার করতে হয়েছে। তাই ওরা বাড়ির ভিতরে আসার আগেই সবাই বাড়ির পিছন দিকের ধানি জমি দিয়ে প্রতিবেশী মুসলমান বাড়ির দিকে চলে যেতে থাকে। আর হামলাকারীরা ঋষিবাড়িতে কাউকে না পেয়ে সব ক'টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরা এতোটা নৃশংস যে গোয়ালে বাঁধা হালের গরু সহই আগুনে সব পুড়িয়ে ভস্ম করে দিলো। অতি উৎসাহীরা আগুন দেওয়ার আগে ঘরে ঢুকে ইচ্ছেমত লুটপাট চালালো।
এরা এসেছিল শুধু মাত্র ঋষিবাড়িতে আক্রমণ করার জন্য। কারণ এই বাড়ির কোনো একজন ছেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে কুরুচিপুর্ণ পোষ্ট দিয়েছিল। তাই তাদের ভিতরের জেহাদি জোশকে দমিয়ে রাখতে না পেরেই এই আঘাত। এরা এতোটাই জেহাদি জোশে উজ্জীবিত হয়েছিল যে, ফিরে আসার পথে যে ক'টি হিন্দু বাড়ি পেয়েছে- সবগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে একেবারে ধ্বংস করে দিলে গেলো। এরা যেভাবে দ্রুত এসেছিল, সেভাবেই আবার ফিরে গেলো। একটা গ্রামের সকল মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, আউটসাইডার কিছু যুবকদের তাণ্ডবলীলা। তবে যারা দেখছিল, এরা সবাই ছিল মুসলমান। অন্তত আজকের দিনে এরা সবাইই মুসলমান হয়েই রইলো। যারা হামলা করতে এসেছে, তারাও মুসলমান। আর হিন্দুদেরকে আঘাত করে তারা তো সাচ্চা মুসলমানের কাজই করেছে। কত বড় সাহস! আমাদের নবীর বিরুদ্ধে কুৎসা গায়!!
একদিনের জন্য শ্রীরামকাঠী গ্রামের মুসলমানেরা 'মানুষ' হতে পারেনা। তাঁরা সেদিন কঠিন মুসলমান বনে যায়! না হলে শ'তিনেক মানুষের ধ্বংসলীলা রুখবার মতো সামর্থ এদের অবশ্যই ছিল। আজ যদি উল্টোটা হতো? শ'তিনেক হিন্দু যুবক কোনো মুসলমান বাড়িতে আঘাত করতে আসতো? তবে কি এরা এভাবে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারতো? আজ মানবতা হোচট খেয়ে এদের ভিতরের গোষ্ঠীতান্ত্রিক মনোভাব প্রকট হয়েছে।
মুজিবর এবং পারুল ভীত হিন্দু প্রতিবেশীদেরকে অভয় দিচ্ছিল। সবাইকে পারুলদের বাড়িতে এনে রাখা হয়েছে। যতক্ষণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়, ততক্ষণ এদেরকে এভাবে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। মোতাহার সন্তোষ মণ্ডলকে নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে গিয়েছে। সন্তোষ মন্ডলের অবস্থা গুরুতর।
এভাবে শ্রীরামকাঠী গ্রামে আবারও সাম্প্রদায়িক হামলা হল। তবে এর পেছনের কারণটা কতটুকু সত্য বা মিথ্যা সেটা সময়েই বের হবে। কিন্তু ক্ষতি যা হবার তাতো হয়েই গেছে। চলমান রাজনীতির কোনো সুক্ষ্ণ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই এই হামলা নাকি এর পিছনে নিছক গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব কাজ করেছে তা বোঝা গেলো না। একধরণের অজানা আতংক সময়ের পিছু ধেয়ে ধেয়ে কেবলি যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। সবাই বিমুঢ়- আতংকে বধির!!
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৭৮৭ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নতুন করে আবার পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে ঢুকতে হয়েছে।
আপনার জন্য অনেক শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
বর্তমান অবস্হা দেখে মন বিষিয়ে উঠে,কিছু মনে করবেন না আমার মন্তব্যে..... অনেক ধন্যবাদ
আমি কিন্তু সাঈদী সাহেবকে খারাপ কিছু দেখাই নাই। এখানে ওনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে, এরপরবর্তী প্রেক্ষাওপটে যা হয়েছে সেটা তুলে ধরেছি। ব্যক্তিগতভাবে ওনার একজন প্রচন্ড ভক্ত,শুধুমাত্র তাফসির এর জন্য।
আর আপনি মনে হয় লেখার মূল ভাবটাই বুঝতে পারছেন না। আশা করছি পরবর্তী পর্বে আপনি কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন। আর লেখার ভিতরে 'সাম্প্রদায়িক দল, 'স্বাধীনতার পক্ষের দল' কিংবা 'স্বাধীনতা বিরোধী দল' বলেছি; কোনো নির্দিষ্ট দলের নাম কি একবারও নিয়েছি? তাই নিজের মত করে কিছু ভাবার অবকাশ নেই। আর সংখ্যালঘুদের উপর কারা আক্রমণ করেছে, পরবর্তী পর্বেই সব ক্লীয়ার হবে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
অনেক শুভেচ্ছা।
আর আগেই বলেছি, আমরা আলোচনা করি বা সমালোচনা করি নিজেদের কন্সেপ্ট পরিষ্কার রাখার জন্য। আপনার থেকে আমি কিছু শিখব, আমার থেকে আপনি কিছু নিবেন- এভাবেই আমাদের চিন্তা-চেতনার উন্নয়ন হবে। তাই আলোচনায় বা মন্তব্যে 'অপরাধের' কিছুই নেই কাহাফ ভাই।
আপনার জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন